ইসরাইলের সাথে ধুন্ধুমার লড়াই দেখলে আপনার মনে হবে ইরানের চেয়ে ভালো আর কেউ নেই। আবার ইরাক-সিরিয়ায় ইরানের গণহত্যার ফিরিস্তি শুনলে আপনার মনে হবে ইরানের শিয়ারা ইসরাইলের চাইতেও খারাপ। সবমিলিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে ইরান রহস্যময় এক চরিত্র। যার ফলে ইরানী প্রেসিডেন্ট ইবরাহীম রাইসির মৃত্যুর পর মুসলিম বিশ্ব দুভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। আজকের প্রতিবেদনে আমরা ইরানের এমন সব দিক তুলে ধরব, যার মাধ্যমে আপনি প্রভাবশালী এই দেশটির ভালো এবং মন্দ— তথা মুদ্রার উভয় পিঠ জানতে পারবেন।
ইরান— জ্ঞানীদের দেশ, কবিদের দেশ। যেই ভূখণ্ড একসময় পৃথীবীর ইতিহাসের সেরা মুসলীম কবি, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী জন্ম দিয়েছে, আধুনিক যুগে এসে সেই ভূখণ্ডই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে সবচেয়ে এগিয়ে আছে। ইঙ্গমার্কিন অপশক্তি বহুরকম নিষেধাজ্ঞা দিয়েও ইরানের ড্রোন, দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র, অন্যান্য সমরাস্ত্র— কোনকিছুর উত্থান ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। পশ্চিমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টার পরেও ইরান অতি শীঘ্রই পারমাণবিক বোমার ঘোষণা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইরান মুসলিম বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সফট কর্নার অর্জন করেছে ইসরাইল বিরোধী অবস্থান নিয়ে। ইসরাইল আরবদের কাছ থেকে ফিলিস্তিন ও মসজিদে আকসা ছিনিয়ে নিলেও আরবরা প্রতিশোধের পরিবর্তে ইহুদীদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করেছে। পক্ষান্তরে ইরান ইসরাইলকে চক্ষু রাঙ্গানি দিয়ে, কথার লড়াই আর ধুন্ধুমার অস্ত্রের মহড়া দিয়ে এমন এক যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করেছে যে, মুসলিম বিশ্ব মনে করতো এই বুঝি ইরান-ইসরাইলের যুদ্ধ লেগে গেল। যদিও দুই দেশের মধ্যে কখনোই যুদ্ধ হয়নি এবং অদূর ভবিষ্যতেও তেমন কোন সম্ভাবনা নেই। বরং কিছুদিন আগে ইরান যেই পদ্ধতিতে ইসরাইলে নামকাওয়াস্তে হামলা চালিয়েছে, সেটাকে অনেকেই নাটক বলে অভিহিত করেছেন।
তবে ইরান যে শিল্পে, সাহিত্যে, প্রযুক্তি, সমরাস্ত্র এবং বিশ্বরাজনীতিতে বিশাল এক শক্তি– সেটা দিবালোকের মত পরিষ্কার। এ কারণে মুসলিম বিশ্বের অনেকেই মনে করেন, একমাত্র ইরানের পক্ষেই ইসরাইলকে শায়েস্তা করা সম্ভব। কিন্তু অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই দেশটির গায়ে এমন সব ঐতিহাসিক কলঙ্ক এবং চলমান অপরাধ রয়েছে, যা তাদের সমস্ত ইতিবাচক দিককে ধুলোয় মিশিয়ে দেয়।
এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রিয় নবী সা. ও সাহাবায়ে কেরামের ব্যাপারে শিয়াদের ভয়াবহ আকীদা। তারা হযরত মুহাম্মাদ সা. এর চাইতে হযরত আলীকে শ্রেষ্ঠ মনে করে। কারণ হযরত আলী তাদের কাল্পনিক ১২ ইমামের প্রথম ইমাম। শিয়াদের ধারণা মতে এই ইমামগণ দুনিয়া ও আখেরাতের মালিক এবং তারা যাকে ইচ্ছা শাস্তি দেন ও ক্ষমা করেন, ইমামদের আনুগত্য করা ফরজ, প্রত্যেক জুমার রাতে ইমামদের মেরাজ হয়, তারা আরশ পর্যন্ত পৌঁছেন।
তারা হাতে গোণা কয়েকজন সাহাবী ছাড়া হযরত আবুবকর, ওমর, উসমান, আম্মাজান আয়েশাসহ প্রায় সমস্ত সাহাবীকে কাফের ও মুরতাদ মনে করে। তাদের দাবি বড় বড় সাহাবীরা কুরআন সংকলনের সময় হযরত আলীর শ্রেষ্ঠত্ব ও ইমাম হওয়া বিষয়ক আয়াতগুলো চুরি করে বাদ দিয়েছেন। এই হিসেবে শিয়াদের ধারণা বর্তমানে আমাদের কাছে থাকা কুরআন খণ্ডিত এবং অসম্পূর্ণ। মূলত এই ধরণের ভয়াবহ আকীদার কারণে এসব শিয়াকে ওলামায়ে কেরাম কাফের ঘোষণা করেছেন। বর্তমানে ইরাক, ইরান ও সিরিয়ায় শিয়াদের এই দলটাই সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইরানে তারাই বিপ্লব ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসীন হয়েছে।
ঐতিহাসিক এই কলঙ্ক ছাড়াও ইরানের সাম্প্রতিক আরেকটি কলঙ্ক হচ্ছে মধ্যপ্রাচে সুন্নি গণহত্যা। ইরাকে, বিশেষ করে সিরিয়ার শিয়া শাসক বাশার আল আসাদকে সহায়তা করতে গিয়ে ইরানী সেনাবাহিনী এবং মিলিশিয়ারা যে ভয়াবহ গণহত্যা চালিয়েছে, তার বিবরণ শুনলে যে কারো পশম দাড়িয়ে যাবে। সিরিয়ার আলেপ্পো, রাক্কা এবং ইদলিবসহ বড় বড় শহরগুলোতে ইরানী বাহিনী এবং তাদের সমর্থিত মিলিশিয়ারা খুন, হত্যা, ধর্ষণের পাশাপাশি ফসফরাস ও ক্লাস্টার বোমা ব্যবহার করে জাতিগত নিধন চালিয়েছে। ফলে আমেরিকার হাতে নিহত জেনারেল কাসেম সোলেমানী ইরানীদের কাছে বীর হলেও ইরাক ও সিরিয়ার মুসলিমদের কাছে কসাই হিসেবেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ঠিক একই কারণে বর্তমান ইরানী প্রেসিডেন্ট ইব্রাহীম রাইসি নিহতের সংবাদে সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা গেছে।
একদিকে বিজ্ঞান ও সমরাস্ত্রে অসামান্য উন্নতি এবং ইসরাইলের সাথে চরম শত্রুতা, অপরদিকে চরম কুফরি আকীদা এবং সুন্নি গণহত্যা— ইরানের এই দ্বিমুখী চরিত্রের কারণে বর্তমানে মুসলিম বিশ্ব তাদের নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট রাইসির মৃত্যুতে না পারছে আলহামদুলিল্লাহ পড়তে, না পারছে ইন্নালিল্লাহ পড়তে। ইরানের এ কেমন দ্বিমুখী চরিত্র?
মামনুন বিন মাসউদ
এমবিএ টাইমস, ডেস্ক রিপোর্ট